ব্যাটিংপিচে টসে জিতে
ব্যাটিং নেওয়ার সিদ্ধান্তটা যতটা যৌক্তিক, ঠিক ততটাইযৌক্তিক কলেজে না গিয়ে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু
বৃষ্টি যেমনব্যাটিংয়ের
সিদ্ধান্তে বাগড়া বাধায়, সেভাবে ঘুমানোর
সিদ্ধান্তে বাগড়া বাধালমা। আম্পায়ারের
নির্দেশে মাঠ ছাড়ার মতো আমাকেও বিছানা ছেড়ে প্যাভিলিয়নেমানে বাথরুমে যেতে হলো। এরপর আর কি! বাসস্ট্যান্ডে
গিয়ে বাসে ওঠার যুদ্ধেরজন্য পজিশন নিলাম। অন্যান্য
দিন দ্রুত বাস চলে আসে। আজকে ‘লেগুনা
দাঁড়ায়এসে, বাসের দেখা নেই’। লেগুনায়
আমি কখনো উঠি না, দম আটকে আসে। কিন্তুহেলপার এত আবেগ নিয়ে জিগাতলা জিগাতলা ডাকছে যে না উঠে পারলাম
না। পা-দানিতেদাঁড়িয়ে আছি, ডান পাশে দুজন তরুণীসহ ছয়জন বসেছেন; সিট খালি নেই। বাঁ পাশেএকটা সিট খালি, কিন্তু দুজন মোটা লোক
এমনভাবে বসেছেন যে মনে হচ্ছে তাঁরা ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব
সিট’ নীতিতে বিশ্বাসী। আমি
বললাম, ‘আঙ্কেল, একটুচেপে বসবেন?’ কোনায় বসা ভদ্রলোক
বললেন, ‘কোথায় চাপব?’ গলায় ঝোলানো আইডিকার্ডের
ফিতা দেখে বুঝলাম উনি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দুজনতরুণীর সামনে আঙ্কেল ডাকায় উনি রাগ করেছেন। ভেতরে
এক পা দিয়ে বসতে যাব আরড্রাইভার দিল টান। সেই
টান সামলাতে না পেরে আমি পড়লাম ডানপাশে বসাতরুণীদ্বয়ের গায়ের ওপর! সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ‘আরে! আশ্চর্য তো!’ বলে চিৎকারকরে উঠলেন। এতে একটা লাভ হলো, বাঁ পাশে বসা দুই মোটামানব একটু সরে আমাকেজায়গা দিলেন। কোনোমতে বসেই আমি দুই
তরুণীর উদ্দেশে ‘সরি’
বললাম। তাতে
ফলহলো উল্টো। চশমাচোখের
তরুণী সঙ্গে সঙ্গে লেকচার শুরু করলেন, ‘মেয়ে দেখলেহুঁশ থাকে না? দেখে তো ভদ্র ঘরের
ছেলেই মনে হয়।’ তরুণীর কথা শেষ হওয়ারসঙ্গে সঙ্গে ফ্লোর পেল অন্য যাত্রীরা!
—পোলাপান উচ্ছন্নে
যাচ্ছে।
—ঠিক! ওই ফেসবুক ওদের
মাথা খাচ্ছে। টেক্সটবুকে মনোযোগ দিলে কি এই অবস্থা হয়?
ডানপাশের মোটা ছেলেটা
হেসে বলল, ‘তোমার তো কলেজে পড়ার বয়স, ম্যাডামদের ওপরে পড়লা ক্যান?’ প্রিটেস্টে ফিজিক্সে
তিন পেয়েও আমি লজ্জা পাই নাই। কিন্তু সহযাত্রীদের
কথায়সত্যিই লজ্জা পেলাম। আমি
কি ইচ্ছা করে পড়েছি? দোষ তো ওই দুই
মোটামানবের।তাঁরা জায়গা নিয়ে এমন
দখলসুলভ আচরণ না করলে এই ঘটনাই ঘটত না। আবার লেকচারদেয়! সবাই মনে হয় লেকচার গাইড পড়ে এসেছে! ব্যাটা ড্রাইভারটাও
কেন যে ওই সময়টান দিল! আর আমিও
গিয়ে পড়লাম ডান পাশে! এক বড় ভাই বলেছিলেন বামপন্থীরাজনীতিই নাকি মুক্তি আনবে। তখন
পাত্তা দিইনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কথাসত্য। বাঁ পাশে পড়লে এত কথা শুনতে হতো না। আমি
পেতাম মুক্তি! ধুর! এ জন্যইলেগুনায় উঠি না! জাতীয় স্বার্থে মোটা
মানুষদের লেগুনা পরিহার করা উচিত! দুই পাশের চাপে আমারঅবস্থা হয়েছে বার্গারের ভেতরে থাকা কাবাবের মতো। তার
ওপর তরুণীদ্বয় মাঝেমাঝেই আমার দিকে রাগী
ভঙ্গিতে তাকাচ্ছেন। তাঁরা আমার চেয়ে কমপক্ষে ১০ বছরেরবড় হলেও এমন আচরণ করলেন,
যেন আমি ভিলেন!
তাঁদের গলায়ও কার্ড ঝুলছে। ফিতায়লেখা ‘ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’। জিগাতলাতেই বোধ হয়
অফিসটা। দু-একবার চোখেপড়েছে। নিশ্চয়ই
তাঁরা ওই অফিসের। কথা তো বলছেন অফিস নিয়েই।
—মার্কেটিং হেড রায়হান
আজকাল খুব বিরক্ত করছে। খালি পেছন পেছন ঘুরঘুর করে।
—হ্যাঁ বলে দাও।
—ওই মাথামোটা গাধাটাকে? অসম্ভব! হেলপার বলল, ‘ভাড়া দ্যান’! যে চাপে আছি, নড়তেই পারি না, ভাড়া দেব কীভাবে? ইশারায় বললাম পরে। পাশের পর্বত ১০ টাকার
নোট দিয়ে বললেন, ‘জাপান নামায়দিস।’
১০ টাকায় মিরপুর টু
জাপান! বাহ! জাপান গার্ডেন সিটিকে মানুষ জাপানবানিয়ে ফেলেছে! লোকটা জাপানে নামতেই
লেগুনার গতি গেল বেড়ে। দুই তরুণীর একজন ব্যাগ থেকেআয়না বের করে দেখলেন মেকআপ ঠিক আছে কি না! সেই সঙ্গে চলছে কথা!
—রায়হান লোকটার
বানানেও ভুল! চিঠির শুরুতে লিখেছে ‘ডিয়ার’! কোন ডিয়ার জানো? চিড়িয়াখানার! পাশের ভার্সিটি পড়ুয়া
মোটা ছেলেটা হেলপারকে বললেন, ‘শংকর নামব, থাবড় দে।’ হেলপার নির্বিকার। ছেলেটা আবার বললেন, ‘কিরে, কথা কানে যায় না? থাবড় দে!’ আমি কল্পনা করলাম, ‘থাবড় দে’ বলতেই হেলপার ছেলেটার
গালে কষে একটা চড় দিল।
‘ঠাস’ শব্দে বাস্তবে ফিরলাম। হেলপার থাপড় দিয়েছে। তবে
লেগুনার গায়ে। ছেলেটানামতেই বেশ হালকা হলো
লেগুনা। একটু দম নিয়ে চশমা পরা তরুণীকে বললাম—
—আপনারা কি ট্রেড
ইন্টারন্যাশনালে জব করেন?
—কেন?
—না মানে যে রায়হান
সাহেবের কথা বলছিলেন, আমি তাঁর ছোট ভাই।
—মানে? রিয়েলি?
—ফোন করে বলি যে
আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
—না না। ফোন
দেওয়ার দরকার কী? দরকার নাই। চেহারা দেখেই বোঝা
যাচ্ছে তাঁরা কতটা চমকে গেছে। হেলপার এসে বলল, ‘ভাড়াদ্যান’। আমি ভাড়া বের করতেই
চশমা পরা আপু বললেন, ‘আশ্চর্য, তুমি ভাড়া দেবেকেন? জিগাতলা নামবে তো? আমি দিচ্ছি।’ শেষে ভাড়া নয়, দিলাম ধন্যবাদ। জিগাতলায় নেমে আপু
বললেন,
—তোমার কলেজ কি এখানেই?
—জি
—গুড! চলো আমরা কিছু
খাই? না করবে না কিন্তু! এই অফারে না করব? অসম্ভব! পাশের আইসক্রিম শপে ঢুকলাম আমরা। একটা
স্কুপনিলাম। ‘টনসিলের প্রবলেম’ বলে আপুরা কিছু খেলেন না। উনারা
ভালোই বিপদেপড়েছেন। বললেন,
—স্যারকে বলবে না
আমাদের কথা।
—কোন স্যার? ফিজিক্স? না কেমিস্ট্রি?
—আরে তোমার ভাইয়ার কথা
বলছি।
—নাহ! বললে ও রাগ করবে। আপনাদের
এত টাকা খরচ করিয়েছি বলে।
—কী সুইট! আমরা যাই
তাহলে। দেরি হয়ে গেছে। দেখা হবে। টা
টা। আমিও কলেজের দিকে
দিলাম হাঁটা। বুঝলাম, পরনিন্দা করলে ধরা
খেতে হয়। আবারহাসিও পেল খুব। আপুরা
কখনো জানবেনও না যে আমার কোনো ভাই নেই! ছিলও নাকোনোকালে! রায়হান লোকটাকে আমি চিনিই না। যা-ই
হোক, আপুদের লেগুনা ভ্রমণটাভালো না হলেও আমার জন্য বেশ ভালো হয়েছে। কিছু
করার নেই। এটাই জগতের নিয়ম!
No comments:
Post a Comment